Sunday 5 October 2014

আমার নানা তাঁর বড় মেয়ে নুরবানুকে অসম্ভব আদর করতেন। নুরবানু হচ্ছেন আমার মা। আমার নানাই শুধু এই নামে তাঁকে ডাকতেন।
মায়ের কাছে গল্প শুনেছি কিশোরী বয়সের আমার মাকে নানা চুল বেঁধে দিতেন। মায়ের লজ্জা লাগত। অন্যরা একটু হাসাহাসিও হয়তো করত। কিন্তু নানা নির্বিকার। তিনি প্রায় প্রতিদিন নিজ হাতে তেল দিয়ে মায়ের চুল বেঁধে দিতেন। নানা মাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট করতে দিতেন না। তাঁর কড়া হুকুম ছিল মাকে বাড়িঘরের কোনো রকম কাজ করতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু আমার নানু ছিলেন উল্টো, মেয়েকে আদরের তাঁর কমতি ছিল না। কিন্তু তাঁর কথা হচ্ছে, মেয়ে বড় হচ্ছে। বিয়ে দিতে হবে। তাঁকে এখনই সংসারের সব কাজকর্ম শেখাতে হবে। ফাঁক পেলেই তিনি মাকে কাজে লাগিয়ে দিতেন নানাকে না জানিয়ে।
একদিন হলো কী, নানা বাইরে দূরে কোথাও গেছেন। ফিরতে রাত হবে। নানু যেন সুযোগ পেয়ে গেলেন। হুকুম দিলেন মাকে বাড়ির পেছনে যে নতুন ঘরটা উঠেছে, সেটা পুরোটা মাটি দিয়ে লেপতে হবে। আমার কিশোরী মা তাঁর মায়ের হুকুম মেনে ঘর লেপতে শুরু করলেন। সারা দিন ধরে ঘর লেপলেন। তাঁর কপালে নিশ্চয়ই বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল... আমার কেন জানি হঠাৎ এই ঘটনাটাই মনে পড়ছে আজ? চোখের সামনে ভাসছে আমার কিশোরী মা নিবিষ্ট মনে ঘর লেপছেন কাদামাটি দিয়ে...।
মা চলে গেছেন এই তো দুই দিন আগে, সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখ পৌনে সাতটায়, ল্যাবএইড হাসপাতালের সিসিইউতে, তাঁর ৮৪ বছর বয়সে। আর আজ এত বছর পরে মায়ের সেই কিশোরী বয়সের ঘর লেপার কথাটা ভেবে কেন আমার এত মন খারাপ হচ্ছে?
আসলে মায়ের বাড়ি মোহনগঞ্জে বাড়ির পেছনে তঁাদের পারিবারিক কবরস্থানে যখন তাঁর কবরটা তৈরি করা হচ্ছিল, সেদিন কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কবরের ভেতরটা ভেজা ভেজা। যেন কেউ হাত দিয়ে নিপুণ ভঙ্গিতে লেপে দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছিল, আরে এই তো সেই মায়ের নিজ হাতে লেপা সেই ঘর...। যেই ঘর সারা দিন ধরে লেপতে গিয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন...। তঁার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল...। এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল চুল...।
মা যেদিন মারা গেলেন, সেদিন হাসপাতালে ছিলাম আমি আর ভাইয়া (মুহম্মদ জাফর ইকবাল)। ভাইয়া বাইরে অ্যাটেনডেন্টদের লম্বা চেয়ারে বসে কিছু একটা লেখালেখি করছিল। আমি মায়ের কাছে সিসিইউতে, তঁার বিশেষ কাচঘেরা ঘরটায়। রাত তখন দুটোর মতো বাজে। মা ছটফট করছিলেন, ঠিক আরাম পাচ্ছিলেন না। আমি বললাম ‘আম্মা, পা টিপে দিই?’ 
বাড়িতে থাকলে প্রায়ই তাঁর পা টিপে দিতে হতো। তিনি মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ টিপে দাও। আমি দিচ্ছিলাম। একসময় হঠাৎ বললেন, ‘তোরা ভাত খেয়েছিস?’
এটাই তাঁর শেষ কথা। আমার মা যেন আমাদের পরিবারের সক্রেটিস। মহান সক্রেটিসের মৃত্যুর সময় তঁার শিষ্যরা এগিয়ে গিয়েছিল হয়তো শেষ মুহূর্তে খুব দামি কোনো কথা বলে যাবেন ভেবে। কিন্তু তিনি বললেন, ‘অমুক আমার কাছে একটা মুরগি পাবে... তাকে সেটা দিয়ো’ মায়ের কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। এখনো আমাদের ভাত খাওয়া নিয়ে ভাবছেন? নিজের কষ্টটা তাঁর মাথায় নেই।
মা মারা গেলেন পৌনে সাতটায়। তাঁর শরীরের সঙ্গে যুক্ত মনিটরে সবগুলো ইন্ডিকেটর একসঙ্গে শূন্য হয়ে গেল। মনিটরে পর পর তিনটা সরলরেখা জানান দিচ্ছে তিনি আর নেই। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ যখন চলে গেলেন, তখন আমরা সবাই তঁার পাশে থাকতে পারিনি। এবার সবাই আছি মায়ের পাশে... বোনেরা–ভাবিরা–বাচ্চারা, ততক্ষণে সবাই চলে এসেছিল। আর কী আশ্চর্য, মা সত্যি সত্যি চলে গেলেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে।
তারও অনেক পরে মোহনগঞ্জে তাঁর কবরে নেমে আমি, নুহাশ আর ছোট মামা মাহবুব হাত বাড়িয়ে আছি। ওপর থেকে ভাইয়া আর মামারা শ্বেতশুভ্র কাফনে জড়ানো আমার মাকে এগিয়ে দিলেন। আমি মাঝখান থেকে মাকে জড়িয়ে ধরলাম দুহাতে। নরম ছোট্ট একটা শরীর। কিন্তু অনেক ভারী। আমরা তিনজনে মিলে মাকে শুইয়ে দিলাম। কোথা থেকে যেন পানি চুইয়ে আসছিল কবরে। সেই পানিতেই তাকে শুইয়ে দিলাম আমরা তিনজন। এই সময় কে যেন ওপর থেকে আমাকে বলল ‘কবরের ভিতরে কাঁদা যাবে না। উঠে এসো!’ কিন্তু কী করে উঠে আসি? নুহাশ আর ছোট মামা ততক্ষণে উঠে গেছে। আমি কাফনের ওপর দিয়ে শেষবারের মতো মায়ের একটা হাত চেপে ধরলাম। এই তো সেই হাত যে হাতে অনেক বছর আগে নানুর হুকুমে ঘর লেপেছিলেন আমার কিশোরী মা... এই হাত ধরেই আমার রোমান্টিক বাবা তাঁর জীবন শুরু করেছিলেন আমার তরুণী মাকে নিয়ে... এই হাত ধরেই আমরা বড় হয়েছি ছয় ভাইবোন... এই হাত এই এত বছরে কতজনের আশ্রয়ের কারণ হয়েছে!... সেই হাত ছেড়ে কি এত সহজেই উঠে আসা যায়? না কেউ পারে?
শেষ একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। দুই বছর আগে বড় ভাই যখন বারডেমের ফ্রিজারে ছিলেন সারা রাত, তখন সেখানে কেউ ছিল না তাঁর পাশে। কিন্তু একজন অচেনা নারী নাকি ছিলেন সারা রাত, একটা জায়নামাজ নিয়ে বসে দোয়া দরুদ পড়েছেন। পরে ব্যাপারটা জেনে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। আসলেই তো আমরা কেন কেউ তাঁর পাশে থাকলাম না সেই রাতে? ওই নারীর মতো? তাই এবার মাকে যখন ফ্রিজিং গাড়িতে নানাবাড়ির বিশাল উঠোনে রাখা হলো। ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দ করছিল ফ্রিজিং গাড়িটা ...আমি সেই গাড়ির পাশে জেগে রইলাম সারা রাত। আমার সঙ্গে অবশ্য তাম্রলিপির তরুণ প্রকাশক রনি, উন্মাদ–এর মেহেদী হাসান খান আর আমার শ্যালক বিপুলও জেগে রইল। একটা রাতই তো, মায়ের পাশে না হয় থাকলাম আমরা। আমার মা কত বিনিদ্র রাত জেগেছেন আমাদের জন্য আর আমি একটা রাত জাগতে পারব না আমার মায়ের জন্য? তাই কি হয়!

0 comments:

প্রিয় কবিতারা...