মিসির আলি, বাংলাদেশের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় চরিত্র। মিসির আলী কাহিনীগুলো রহস্যমাত্রিক। মিসির আলির কাহিনীগুলো ঠিক গোয়েন্দা কাহিনী নয়, কিংবা 'ক্রাইম ফিকশন' বা 'থ্রিলার'-এর মতো খুনি-পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া নয়, কিংবা বরং মনস্তাত্ত্বিক, বিজ্ঞাননির্ভর এবং প্রচন্ড যুক্তিনির্ভর কাহিনীর বুনটে বাঁধা। বরং অনেক ক্ষেত্রে একে রহস্যগল্প বলা চলে। চারিত্রিক দিক দিয়ে মিসির আলি চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের আরেক অনবদ্য সৃষ্টি হিমু চরিত্রটির পুরোপুরি বিপরীত। তরুণ হিমু চলে প্রতি-যুক্তির (anti-logic) তাড়নায় ; অপরপক্ষে বয়োজ্যেষ্ঠ মিসির আলি অনুসরণ করেন বিশুদ্ধ যুক্তি (pure logic)। এই যুক্তিই মিসির আলিকে রহস্যময় জগতের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে সাহায্য করে। সেসব কাহিনীর প্রতিফলন ঘটেছে মিসির আলি সম্পর্কিত প্রতিটি উপন্যাসে।
চরিত্র রূপায়ন
ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ মিসির আলি চরিত্রটির ধারণা প্রথম পেয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে, স্ত্রীর সাথে গাড়িতে ভ্রমণের সময়। চরিত্রটির ধারণা মাথায় চলে এলেও তিনি মিসির আলি চরিত্রের প্রথম উপন্যাস "দেবী" লিখেন এই ঘটনার অনেকদিন পর।চরিত্রের স্বরূপ
উপন্যাসের কাহিনী অনুসারে মিসির আলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের "মনোবিজ্ঞান" (Psychology) বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক (খন্ডকালীন)। শুধুমাত্র একজন শিক্ষক হিসেবেই নন, তাঁর অনুসারীদের কাছেও তিনি বেশ মর্যাদাবান একজন চরিত্র হিসেবে উল্লিখিত। সেজন্য উপন্যাস বা বড় গল্পে, মিসির আলিকে বোঝাতে লেখক 'তার' লেখার পরিবর্তে সম্মানসূচক 'তাঁর' শব্দটির ব্যবহার ক'রে থাকেন।
মিসির আলির বয়স ৪০-৫০-এর মধ্যে। তাঁর মুখ লম্বাটে। সেই লম্বাটে মুখে এলোমেলো দাড়ি, লম্বা উসখো-খুসকো কাঁচা পাকা চুল। প্রথম দেখায় তাঁকে ভবঘূরে বলে মনে হতে পারে; কিছুটা আত্মভোলা। তাঁর হাসি খুব সুন্দর, শিশুসুলভ। মিসির আলির স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো।
তিনি মানুষের মন, আচরণ, স্বপ্ন এবং নানাবিধ রহস্যময় ঘটনা নিয়ে অসীম আগ্রহ রাখেন। হুমায়ুন আহমেদের নিজের ভাষ্যে:
“ | মিসির আলি এমন একজন মানুষ, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। যে পৃথিবীতে চোখ খুলেই কেউ দেখে না, সেখানে চোখ বন্ধ করে দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা। | ” |
চরিত্রটির পরিচিতি দিতে গিয়ে হুমায়ুন আহমেদ বলছেন:
“ | [মিসির আলি] একজন মানুষ, যাঁর কাছে প্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলা বড় কথা, রহস্যময়তার অস্পষ্ট জগৎ যিনি স্বীকার করেন না। | ” |
মিসির আলি চরিত্রে হুমায়ুন আহমেদ, পরস্পর বিপরীতধর্মী দুটি বৈশিষ্ট্য 'যুক্তি' এবং 'আবেগ'কে স্থান দিয়েছেন।
মিসির আলি একজন ধূমপায়ী। তিনি 'ফিফটি ফাইভ' ব্র্যান্ডের সিগারেট খান। তবে তিনি প্রায়ই সিগারেট ছেড়ে দেবার চেষ্টা করেন। তাঁর শরীর বেশ রোগাটে আর রোগাক্রান্ত। নানারকম রোগে তাঁর শরীর জর্জরিত: লিভার বা যকৃৎ প্রায় পুরোটাই অকেজোঁ প্রায়, অগ্নাশয়ের কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে, রক্তের উপাদানে গড়বড়, হৃদপিন্ড ড্রপ বিট দেয়। এজন্য কঠিন এসব রোগের পাশাপাশি সাধারণ যেকোনো রোগই তাঁকে বেশ কাহিল করে ফেলে। ফলে প্রায়ই অসম্ভব রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন।
মিসির আলি যুক্তিনির্ভর একজন মানুষ বলেই অসম সাহসিক। ভূতাশ্রিত স্থানেও রাত কাটাতে তিনি পিছপা হোন না, বরং এজন্য থাকেন যে, তাতে তিনি রহস্যময়তার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারবেন। মিসির আলির অনেকগুলো পারঙ্গমতার মধ্যে অন্যতম হলো তিনি যে কাউকে, বিশেষ করে ঠিকানাওয়ালা মানুষকে, খুব সহজে অজানা স্থানেও খুঁজে বের করতে পারেন। এজন্য তিনি টেলিফোন ডিরেক্টরি, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর, টিভি-বেতার-এর লাইসেন্স নম্বর, পুলিশ কেস রিপোর্ট, হাসপাতালের মর্গের সুরতহাল (পোস্টমোর্টেম) রিপোর্ট ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে থাকেন। মিসির আলি প্রকৃতির বিষ্ময়ে বিষ্মিত হলেও প্রচন্ড যুক্তির বলে বিশ্বাস করেন প্রকৃতিতে রহস্য বলে কিছু নেই। তিনি সন্দেহবাদী হওয়াসত্ত্বেয় ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী অর্থাৎ একজন আস্তিক।
মিসির আলি মূলত নিঃসঙ্গ একজন মানুষ, মোটামুটি সব উপন্যাসে তাঁকে এভাবেই রূপায়িত করা হয়। কিন্তু "অন্য ভূবন" উপন্যাসে মিসির আলি বিয়ে করে ফেলেন বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু পরবর্তি উপন্যাসগুলিতে আবার তাঁকে নিঃসঙ্গ একজন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এপ্রসঙ্গে লেখক নিজেই স্বীকার করেন যে, "এটি বড় ধরণের ভুল" ছিলো। মিসির আলির মতো চরিত্র বিবাহিত পুরুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। আর সেই ভুল শুধরে পরবর্তি উপন্যাসগুলোতে আবার মিসির আলিকে নিঃসঙ্গ হিসেবে উপস্থাপন করেন লেখক। ফলে মিসির আলি চরিত্রটি যা দাঁড়ায়: মিসির আলি ভালোবাসার গভীর সমুদ্র হৃদয়ে লালন করেন, কিন্তু সেই ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দেবার মতো কাউকেই কখনও কাছে পান না। ভালোবাসার একাকীত্বে জর্জরিত মিসির আলির নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে বিভিন্ন সময় কিশোরবয়সী কাজের লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন: "আমি এবং আমরা" উপন্যাসে "বদু" নামের একটি, ১৫-১৬ বছরের কাজের ছেলের উল্লেখ রয়েছে। এরকম কাজের লোককে মিসির আলি লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেন। আবার "অন্য ভূবন" উপন্যাসে "রেবা" নামের একটি কাজের মেয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।
মিসির আলির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত সারমর্ম করতে হুমায়ূন আহমেদই লিখেন: মিসির আলি নিঃসঙ্গ, হৃদয়বান, তীক্ষ্ণ ধীশক্তির অধিকারী। কাহিনী অনুসারে তিনি অকৃতদার। চরিত্রটি লেখকেরও, প্রিয় চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।
মিসির আলি চরিত্রটি এতোটাই পাঠক জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে, অনেকেই তাঁকে রক্তমাংসের মানুষ ভাবতে শুরু করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ প্রায়ই জিজ্ঞাসিত হন যে, মিসির আলি কি কোনো বাস্তব চরিত্রকে দেখে লেখা কিনা। এর নেতিবাচক উত্তর পেয়ে অনেকেই আবার মিসির আলি চরিত্রটির মধ্যে লেখকেরই ছায়া খুঁজে পান। এপ্রসঙ্গে স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদই উত্তর করেন:
“ | না, মিসির আলিকে আমি দেখিনি। অনেকে মনে করেন লেখক নিজেই হয়তো মিসির আলি। তাঁদেরকে বিনীতভাবে জানাচ্ছি- আমি মিসির আলি নই। আমি যুক্তির প্রাসাদ তৈরি করতে পারি না এবং আমি কখনও মিসির আলির মতো মনে করিনা প্রকৃতিতে কোনো রহস্য নেই। আমার কাছে সব সময় প্রকৃতিকে অসীম রহস্যময় বলে মনে হয়। | ” |
কিন্তু এই অভয়বাণীসত্ত্বেয় নলিনী বাবু B.Sc উপন্যাসে লেখককেই মিসির আলীর ভূমিকায় দেখা যায়, এবং তিনি যে মিসির আলী থেকে আলাদা কিন্তু তাঁর স্রষ্টা তার স্পষ্ট উল্লেখ করেন:
“ | আমি (লেখক) এই ভেবে আনন্দ পেলাম যে, সালেহ চৌধুরী (লেখকের সফরসঙ্গী) মিসির আলিকে উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে দেখছেন না। অতি বুদ্ধিমান মানুষও মাঝে মাঝে বাস্তব-অবাস্তব সীমারেখা মনে রাখতে পারেন না। |
মিসির আলি-কেন্দ্রিক লেখনীসমূহ
উপন্যাস
- দেবী (সিরিজের প্রথম উপন্যাস)
- নিশীথিনী ("দেবী"র ধারাবাহিক উপন্যাস)
- নিষাদ
- অন্য ভূবন
- বৃহন্নলা
- বিপদ
- অনীশ
- মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্য
- আমি এবং আমরা
- তন্দ্রাবিলাস
- হিমুর দ্বিতীয় প্রহর (হিমু চরিত্রের সাথে মিসির আলির সাক্ষাৎ)
- আমিই মিসির আলি
- বাঘবন্দি মিসির আলি
- কহেন কবি কালিদাস
- হরতন ইশকাপন
- মিসির আলির চশমা
- মিসির আলি, আপনি কোথায়?
- মিসির আলি আনসল্ভ্ড
- নলিনী বাবু B.Sc (প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১০)
- "পুফি"
- "যখন নামিবে আঁধার" (প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২০১২)
গল্পগ্রন্থ
- ভয় ("ভয়", "জিন-কফিল" ও "সঙ্গিনী" নামক তিনটি গল্পের সংকলন)
মিসির আলী সংক্রান্ত উপন্যাস এর ডাউনলোড লিংক
0 comments: