Tuesday 17 June 2014

লিখেছেনঃ Ismail Arman parl_maiden

পার্ল মেইডেন মূল: হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড রূপান্তর ও প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: ইসমাইল আরমান প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি, ২০০৯
এ-গল্প মিরিয়ামের। পিতৃ-মাতৃহীন, অসহায়, আশ্রিতা এক খ্রিস্টান তরুণী... ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধের মাঝখানে যে-মেয়েটি ন্যায়, সত্য ও শান্তির জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করেছিল।
এ-গল্প মারকাসের। দুঃসাহসী, দক্ষ, নিবেদিতপ্রাণ এক রোমান সৈনিক... মিরিয়ামের ভালবাসা যাকে বদলে দিয়েছিল।
এ-গল্প ক্যালেবের। রুক্ষ, একগুঁয়ে, প্রতিশোধপরায়ণ এক ইহুদি যুবক... মিরিয়ামের প্রত্যাখ্যান যাকে উন্মাদ করে তুলেছিল।
এ-গল্প হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের লেখা। শাশ্বত প্রেম, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর নির্দয় প্রতিহিংসার এক রুদ্ধশ্বাস উপাখ্যান।
আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে কি?
---পেছনের গল্প---
২০০৮ সাল। লেখালেখির দেড় দশকের বেশি অতিক্রম করে ফেলেছি। তবে অয়ন-জিমি নামের একটি কিশোর সিরিজের লেখক হিসেবে সামান্য পরিচিতি ছাড়া আর কোনও উল্লেখযোগ্য অর্জন নেই। তা ছাড়া সিরিজটার বিক্রি আশানুরূপ নয়, ফলে ২০০১ এর পর থেকে আর কোনও বই বেরোয়নি। রহস্যপত্রিকায় কালেভদ্রে একটা-দুটো গল্প ছাপা হয়, লেখালেখি বলতে ওটুকুই। সবমিলিয়ে বেশ হতাশাজনক একটা পরিস্থিতি, মন তাই বিষণ্ন। এ অবস্থায় একদিন গেলাম সেগুনবাগিচায়... সেবা প্রকাশনীতে। কাজে নয়, স্রেফ আত্মার টানে। ওখানে গেলেই মন ভাল হয়ে যায়, কারণটা আর কিছু না... প্রিয় কাজীদার জন্যে। বড় কোনও লেখক নই আমি, তারপরেও কেন যেন সাক্ষাৎ চাইলেই আমার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। গল্প করেন, খবরাখবর নেন। কিশোর অবস্থায় প্রথম বই লিখেছিলাম, এখনও আমি সেই ছোট্ট ছেলেটি রয়ে গেছি তাঁর চোখে... বোধহয় সেই স্নেহ থেকেই দেখা না দিয়ে পারেন না। সেদিনও দেখা করলেন। কথাবার্তার এক ফাঁকে নিজের হতাশার কথা জানালাম। জবাবে ছোট্ট করে তিনি শুধু বললেন, ‘তুমি অনুবাদ করো। তোমার হাতে ভাল আসবে।’
লেখালেখির ধারা পরিবর্তনের পরামর্শ যে আগে কখনও পাইনি, তা নয়। এর আগেই কাজী শাহনূর হোসেন আমাকে ওয়েস্টার্ন লিখতে বলেছিলেন। অ্যাডাপ্টেশনের জন্য ইংরেজি দুটো বইও দিয়েছিলেন। পড়ার পর কোনোটাই পছন্দ হয়নি। আমার নিজের সংগ্রহে আর কোনও বইও ছিল না। তাই ওয়েস্টার্ন আর লেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কাজীদার কথায় নিজের ভিতরে আলাদা এক অনুপ্রেরণা অনুভব করলাম। অনুবাদ আমার জন্য নতুন কিছু নয়, রহস্যপত্রিকায় আমার সব লেখাই বিদেশি কাহিনির অনুবাদ। তবে সেগুলো ছোটগল্প। গোটা উপন্যাস অনুবাদ করবার সাহস করিনি কখনও। কিন্তু কাজীদা যখন বলেছেন, তখন তো আর তাঁর কথা অগ্রাহ্য করা যায় না। কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম কাজটায়।
প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, বই বাছাই করা। কোন্ লেখকের কোন্ বই অনুবাদ করব। লেখক সহজেই নির্বাচন করা গেল। কাজী শাহনূর হোসেন বললেন, ‘হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের বই ধরুন। লেখক যেমন ভাল, বাজারে চাহিদাও বেশি।’ ভাল কথা, কিন্তু হ্যাগার্ডের কোন্ বই অনুবাদ করব? আমার জানামতে নামকরা সবগুলোই (শী, রিটার্ন অভ শী, সলোমনের গুপ্তধন, অ্যালান কোয়াটারমেইন, ইত্যাদি) হয়ে গেছে। এরপরে কোনটা ভাল জানতে হলে পড়ে দেখতে হবে মূল ইংরেজিগুলো। ভয় ধরানো ব্যাপার... কারণ হ্যাগার্ডের পুরনো ধাঁচের লেখনীতে একের পর এক বই পড়া দুঃসাধ্য কাজ। ইণ্টারনেটের সাহায্যে কিছুটা গবেষণা করলাম - কাহিনিসংক্ষেপ আর পাঠক প্রতিক্রিয়া দেখে শর্টলিস্ট বানালাম একটা। শেষ পর্যন্ত পছন্দ করলাম নীচের বইটা... পার্ল মেইডেন। পড়তে শুরু করেই ভাল লেগে গেল। প্রাচীন রোমান পটভূমিতে প্রেম, প্রতিহিংসা, ঈর্ষা আর সংগ্রামের এই অপূর্ব কাহিনি আমাকে মুগ্ধ করে ফেলল। ঠিক করলাম, এ-ই দিয়ে শুরু হবে আমার অনুবাদ যাত্রা।
দীর্ঘ কয়েক মাস খাটাখাটনির পর শেষ হলো লেখা। ভয়ে ভয়ে জমা দিলাম কাজীদার কাছে। কয়েক দিন পর ফোন করে প্রচ্ছদ চাইলেন তিনি। বুঝলাম, বই ছাপা হচ্ছে। ফোনে বেশি কথা বলা সম্ভব নয়, কয়েকদিন পর প্রচ্ছদ জমা দিয়ে ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বইটা কি পড়ে দেখেছেন, কাজীদা? কেমন হয়েছে?’
‘পুরোটা পড়িনি। প্রথম পরিচ্ছেদ পড়েছি। চমৎকার লিখেছ।’
‘সে কী! পুরোটা না পড়লে কী করে বুঝলেন বইটা ছাপার যোগ্য হয়েছে?’
‘ওই এক পরিচ্ছেদ পড়লেই বোঝা যায়। তা ছাড়া তোমার লেখা তো আমি আগেও পড়েছি।’
‘কিন্তু সম্পাদনার প্রয়োজন আছে না? ভিতরে যদি ভুলভাল থেকে যায়?’
‘নেই বলেই তো মনে হলো। তাও তুমি যদি চাও তো প্রুফের সময় চোখ বুলিয়ে দিয়ো।’
তা-ই করলাম। শেষ পর্যন্ত ২০০৯ এর জানুয়ারিতে বের হলো পার্ল মেইডেন। পরের মাসে বইমেলা। এতদিন পর একটা বই বেরুল... কৌতূহল থেকে বেশ কয়েকদিন গেলাম মেলায়, বসে রইলাম সেবার স্টলে। কেউ আমাকে চেনে না, চুপচাপ দেখছি... পাঠক বই কিনতে আসছেন, হ্যাগার্ডের বই চাইছেন, কিন্তু অনুবাদকের জায়গায় আমার নাম দেখে ভুরু কুঁচকে ফেলছেন। পরক্ষণে অবশ্য সেবার মনোগ্রামের দিকে তাকিয়ে দাম চুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বইটা। বই ভাল কি মন্দ হলো বুঝতে পারছি না।
মেলা শেষ হবার কয়েকদিন পর আমার কলেজ পড়ুয়া ভাগ্নি (খুব একটা গল্পের বই পড়ে না) এসে জিজ্ঞেস করল, ‘মামা, পার্ল মেইডেন কি তুমি অনুবাদ করেছ?’
‘হ্যাঁ তো। কেন?’
‘আমার বান্ধবীরা খুব প্রশংসা করছে বইটার। তোমার অটোগ্রাফ চাইছে। সই করে কয়েক কপি দাও তো। আর আমাকেও একটা দিয়ো। পড়ে দেখব।’
অবশেষে মুখে হাসি ফুটল আমার। বুঝলাম, পরীক্ষায় উৎরে গেছি। কাজীদা ঠিকই বলেছিলেন, অনুবাদ ভাল আসবে তোমার হাতে। লেখক হিসেবে আমার এখন যা পরিচিতি, যা সুনাম... সবই এসেছে অনুবাদের কল্যাণে। শুধু তা-ই নয়, আমাকে ও সেবার অন্যান্য সব লেখক-অনুবাদককে হাতে ধরে লিখতে শিখিয়েছেন তিনি। অসাধারণ এই মানুষটির গাইডেন্সে আরও কত লেখকের যে জীবনের মোড় ঘুরে গেছে, তা বলে শেষ করা যাবে না।
জয়তু কাজীদা।

0 comments:

প্রিয় কবিতারা...