Sunday 22 June 2014

হুয়ান কর্টেয ওরফে সাবাডিয়া। দুই জাতির রক্ত বইছে ওর শরীরে। চোখের তারায় পিস্তলবাজের কঠিন দৃষ্টি। কিন্তু সাবাডিয়া পিস্তলবাজ নয়। ওদিকে টেক্সাসের ছোট্ট এক শহরে দানা বেঁধে উঠেছে হিংসা - অপেক্ষা করছে বিপদ। সাবাডিয়ার জন্যে। আগাগোড়া অ্যাকশনে ভরপুর। রুদ্ধশ্বাসে পড়ে শেষ করার মতো বই।
prottai
রিচার্ড জেসাপের সাবাডিয়া অবলম্বনে লেখা হয়েছে সেবার ওয়েস্টার্ন সিরিজের চল্লিশতম বই প্রত্যয়। প্রথম যখন বেরিয়েছিল, তখনই পড়েছিলাম। এরপরে গত সাতাশ বছরে আরও কতবার যে রিভাইজ দিয়েছি, তা নিজেও জানি না। বোধহয় বলার প্রয়োজন নেই যে, এটি আমার প্রিয় ওয়েস্টার্ন? কাহিনিটা এরকম - হুয়ান কটেয ওরফে সাবাডিয়া একজন মেক্সিকান বিপ্লবী। ব্যর্থ সংগ্রাম শেষে বাধ্য হয় সীমান্ত পেরিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে আসতে। পৌঁছায় কোলি নামে একটি ছোট্ট শহরে। সেখানে প্রবল প্রতাপশালী এক র‌্যাঞ্চারের ছেলে ধরা পড়েছে এক দেহপসারিণীকে খুন করে। শহরবাসী ক্ষিপ্ত তার বাবার উপরে, তাই ওরা চাইছে ছেলেটিকে যেন-তেন উপায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে। ছেলের বাবাও একদল পিস্তলবাজ নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে শহরের বাইরে, হুমকি দিয়েছে তার ছেলের কিছু হলে পুরো শহর ধ্বংস করে দেবে। দু’পক্ষের মাঝখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে শহরের নিঃসঙ্গ শেরিফ - ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শুরুতে এসবের মাঝে জড়াতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত বিবেকের ডাকে শেরিফের সঙ্গে যোগ দেয় সাবাডিয়া।

এই বইটি বহুদিক থেকে আর দশটা ওয়েস্টার্নের চেয়ে ব্যতিক্রম। রওশন জামিলের কাব্যিক ভাষা তো রয়েছেই, কাহিনিও ভিন্নধর্মী। ভালমন্দের সাধারণ ব্যাখ্যা খাটবে না চরিত্রগুলোর বেলায়। ভিলেনের মাঝেও আপনি খুঁজে পাবেন মানবতা। টাকাপয়সা বা ক্ষমতার লোভে লড়াই করছে না সে, করছে সন্তানকে বাঁচানোর জন্যে। শহরবাসীর প্রতিই একসময় ক্ষোভ সৃষ্টি হবে পাঠকের, যারা লিঞ্চ করে একটি অসহায় ছেলেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে চাইছে। চরিত্র হিসেবে শেরিফ টম্পসন, বুড়ো হ্যাপ, পিস্তলবাজ পিস্তল (হ্যাঁ, নামটা পিস্তলই বটে), লুকাস পিটম্যান, তার বাবা স্যল পিটম্যান... প্রত্যেকেই অনবদ্য। তবে এদের সবাইকে ছাপিয়ে গেছে নায়ক সাবাডিয়া। আর সব ওয়েস্টার্ন নায়কের মত সে দুর্ধর্ষ পিস্তলবাজ তো বটেই; এ ছাড়াও তার সঙ্গে থাকে র-হাইডের লম্বা এক চাবুক, ডগায় ধারালো ছুরির ফলা বসানো, যেটা ব্যবহারে সে আগ্লোয়াস্ত্রের চেয়ে কম ক্ষিপ্র নয়। তবে সাবাডিয়ার চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার অন্তর্দ্বন্দ্ব... তার হতাশা... তার বেদনা। পড়তে পড়তে পাঠক নিজেই তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। কয়েকটা লাইন নীচে তুলে দিলাম।

‘‘আগুনের আলোয় বসে একবার শিখা তারপর চাঁদের দিকে তাকিয়ে অশ্বারোহী ভাবল ওর সঙ্গে যাদের চিন্তাভাবনার মিল আছে তাদের যদি পরপার থেকে কথা বলার ক্ষমতা থাকত, এরকম অবস্থায় কী বলত ওরা? লুতেরো, মার্কো, লুই, জর্জ? আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তের যে পাশেই থাকুক সাবাডিয়া, ওদের বক্তব্যে কি তাতে হেরফের হত? শয়তানের চেহারা সে নিজেই যখন সনাক্ত করতে পেরেছে তখন সাবাডিয়ার সামনে কি আর কোন পথ খোলা আছে? এই শয়তানের বিরুদ্ধেই কি সাবাডিয়া চিরদিন লড়ে আসছে না? দেশ যা-ই হোক তার বিশ্বাসটা কি বদলে যাবে তাই বলে, হুয়ান কর্টেয, সাবাডিয়া? লড়াইটা, শেরিফ টম্পসনকে তুমি বলেছ, তোমার জন্য হবে নিরুত্তাপ, শীতল। কতটা শীতল, সাবাডিয়া? তোমার চেতনাকে দমিয়ে দিতে রিও গ্র্যাণ্ডের বুকে একটা সূক্ষ্ম রেখাকে সুযোগ দেবে তুমি? ওরকম একটা সূক্ষ্ম রেখা, এত সূক্ষ্ম যে আজ পর্যন্ত কেউ তা দেখতে পায়নি এবং হয়তো ভবিষ্যতেও পাবে না, তোমার আবেগ তোমার জীবনকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, আর তুমি, সাবাডিয়া, নীরবে সহ্য করবে তাই? রিও গ্র্যাণ্ডের মধ্যবর্তী ওই সূক্ষ্ম রেখার একদিকের লড়াইটা বড়। অন্য পাশেরটা ছোট - তফাত শুধু মাপের। যাও, সাবাডিয়া, যাও। উঠে দাঁড়াল অশ্বারোহী। ঝটপট লাথি মেরে আগুনটা নিভিয়ে ফেলল সে, পটের তলানি কফিটুকু ছাইয়ের গাদায় নিক্ষেপ করে এগোল স্ট্যালিয়নের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে নিজের ট্রেইল মাড়িয়ে ক্ষিপ্র গতিতে ফিরে চলল সে কোলির উদ্দেশে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের অনন্ত আপসহীন সংগ্রামে যোগ দিতে...’’

সত্যিই অপূর্ব, নয় কি? কাজেই যদি ওয়েস্টার্নের ভক্ত হোন আপনি, সেইসঙ্গে চান জমজমাট কাহিনির পাশাপাশি চিন্তাভাবনার খোরাক... দেরি না করে এখুনি বসে পড়ুন এই বই নিয়ে। হতাশ হবেন না। এই বই চিরদিনের মত ছাপ রেখে যাবে আপনার হৃদয়ে।

পুনশ্চঃ মূল বইটির উৎস খুঁজতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়েছি। স্বয়ং রওশন জামিল পর্যন্ত বলতে পারেননি, ভুলে গেছেন। শেষ পর্যন্ত সেবার প্রচ্ছদশিল্পী ও ওয়েস্টার্ন বিশেষজ্ঞ (!) রনবীর আহমেদ বিপ্লব ভাইকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম মূল বইটির নাম। যদ্দূর বুঝলাম, অ্যাডাপ্টেশনের চেয়ে এই বইটি অনুবাদের ক্যাটাগরিতেই বেশি পড়ে। নায়কের নামই বদলানো হয়নি, কাহিনিরও নড়চড় হয়নি মোটেই। তাই বলে রওশন জামিলের দক্ষ লেখনীকে ছোট করছি না একবিন্দু। অনুবাদ হোক, বা অ্যাডাপ্টেশন... এটি আমার প্রিয়তম বইগুলোর একটি হয়ে রইবে।

লিখেছেনঃ Ismail Arman

0 comments:

প্রিয় কবিতারা...