Sunday 5 October 2014

‘ইন্দ্রাণী, মায়ের শরীরটা ভালো না, এবারের পুজোর ছুটিতে একবার আয়।’—দাদার চিঠি। মুকুলগঞ্জ আমাকে ডাকল, ১২ বছর পর! চিঠিটা পড়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়লাম। এ যেন বাড়ির পাশের সর্ষে ক্ষেত, আমি ছুটছি লাল ফড়িঙটার পিছুপিছু। আমার ফ্রক বাতাসে উড়ছে...লাল ফড়িঙের পাখা উড়ছে...আমি...ফড়িং...আমি... ফড়িং...আমি...শ্যামলদার পাঞ্জাবি। মুকুলগঞ্জের লেজ ধরে শ্যামলদাটা এসেই গেল! আসবেই জানতাম। মুকুলগঞ্জ আমাকে ছাড়লে কী হবে, নাছোড়বান্দা শ্যামলদাটা কি আমায় ছেড়েছে! এমনও কী হতে পারে, আমিই শ্যামলদাকে ছাড়িনি! বারোটা বছর এই ধ্রুপিদ অস্পষ্টতার মধ্যেই কেটে গেল। কার দায় পড়েছে জানার কে কাকে ছেড়ে গেল? ধুত্তোর!
দোতলার দক্ষিণের ঘরটা আমার। বিয়ের পর যেহেতু মান-অভিমান ভেঙে বাপের বাড়িতে প্রথম পদার্পণ, তাই যত্ন–আত্তিটাও বাড়াবাড়ি রকমেরই হচ্ছে বুঝতে পারছি। তার ওপর সময়টা পূজার। এখানে পা দেওয়ার পর থেকে আমার বরসহ ছানাপোনাদের সময় কাটছে পাড়ার প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। আমার ‘উনি’ পারেনও বটে। শরীর থেকে জার্নির ধকলটুকু গেল না অব্দি, উনি পাড়া বেড়াতে নেমে পড়লেন। আমি যেতে পারছি কি পারছি না তার ধারটুকুও ধারছেন না। শুধু কি তাই? বাড়ি ফিরে ঝোলা থেকে রাজ্যের উটকো গল্প আমার কানের পোকা নড়িয়ে না শোনানো অব্দি তার শান্তি নেই। এই তো সেদিন পালপাড়া ঘুরে এলেন। এসেই ভাত খেয়ে পান চিবুতে চিবুতে একখানা হাতুড়ি পেটালেন, ‘আচ্ছা শ্যামল মাস্টারটা কে ছিল বলো তো?’
এই রে সুইটা বোধ হয় হাতে বিঁধেই গেল। উফ!
‘দেখতে পাচ্ছ সেলাই করছি। এর মাঝে এত কথা কেন তোমার বাপু?’
কেউ কি জানে কথার ফাঁকে আমি শ্যামলদাকে সরাচ্ছি। লোকটা আমাকে এত দিনেও শান্তি দিল না। উনি ব্যস্ত হলেন, ‘উফ, একটু দেখে সেলাই করবে না? কত রক্ত পড়ছে দেখ। দাঁড়াও, ব্যান্ডেজ আনছি।’
‘হয়েছে, বোসো তো, এমন কিছু হয়নি।’
উনি শান্ত হয়ে বসে আবার আমাকে অশান্ত করলেন, ‘লোকটার খুব প্রশংসা শুনলাম। বিরাট পরোপকারী। মুকুলগঞ্জের স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরি...সবকিছুর উদ্যোক্তা তিনি। একটা মিউজিয়ামও নাকি করছিলেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। কোথায় এখন উনি, জানো? মুকুলগঞ্জই বা ছাড়লেন কেন?’
খুব অবাক লাগল ওর কথা শুনে। মুকুলগঞ্জের প্রতিটি ইট–কাঠ এর উত্তর জানে। অথচ কেউ ওকে বলেনি। আমিই কি বলতে পেরেছি?
পূজা ঘনিয়ে এল। প্রতিমা দেখতে বেড়িয়ে পথে একদিন হেড মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলেন। পূজার পরেই স্কুলের রি–ইউনিয়ন হচ্ছে, থাকার জন্য অনুরোধ করলেন। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে আমিও দোনোমোনো পায়ে এগোচ্ছি। ছয় হাত পেছনে মাস্টারমশাইয়ের গলা অথবা ঢাকের আওয়াজ শুনলাম, ‘রি-ইউনিয়নে থেকো ইন্দ্রাণী, শ্যামল আসছে...’
অভিজাত বংশের মেয়ে হয়ে সামান্য একজন গৃহশিক্ষকের প্রেমে পড়ার শাস্তি মুকুলগঞ্জ কি আমাকে দেয়নি? হায় ঈশ্বর! আর কেন? রক্ষা করো আমাকে। পালাচ্ছি আমি। আমার উনাকে রি-ইউনিয়নের দিনেই ফেরার টিকেট কাটতে বেজায় তাড়া দিলাম। উফ, আমি একটু শান্তি চাই!
বাইরে মধ্য আশ্বিনের বৃষ্টি। কিন্তু আমি তো আমার নিজের বৃষ্টিতে ভিজছি। ব্যাগ গোছানো শেষ। সবার সঙ্গে বিদায় পর্ব চলছে। মা চোখ ভেজা আঁচলে ছেলেমানুষি আবদার মাখাচ্ছেন, ‘ইন্দু, আর কয়টা দিন থেকে গেলে পারতি।’ 
বৃষ্টি অবশেষে ধরে এসেছে। পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশে দুটো জোড়া শালিক হলুদ রোদ পোহাচ্ছে। চারটে শালিকে যেন কী হয়, মনে পড়ছে না। আর মনে পড়ে কী হবে, খবর পেয়েছি শ্যামলদা রি-ইউনিয়নে থাকেননি, ভোরের গাড়িতে চলে গেছেন। আমার বিচ্ছিরি জেদের কারণে বাকি জীবনেও আর তার সঙ্গে দেখা হবে না। শাবাশ ইন্দ্রাণী, এই তো মনে মনে চেয়েছিলে, তাই না?
মুকুলগঞ্জ ধীরে ধীরে পেছনে সরে যাচ্ছে। স্টেশনে যাওয়ার পথটুকুতে আমি একবারের জন্যও চোখ খুলতে পারিনি। বারো বছর আগে এই রাস্তা দিয়েই তো চৌদ্দ বছরের ইন্দ্রাণী খালি পায়ে দৌড়েছিল...শ্যামলদাকে নিয়ে হারিয়ে যাওয়া ট্রেনের পিছু পিছু। 
স্টেশন এসে গেছে। আমার উনি টিকেট কাউন্টারে গেলেন। ছোট ছোট পায়ে শান্তিনিকেতনি ঝোলা কাঁধে স্থির দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকা লোকটি কে? আমি বিস্ময়ে স্থাণু হলাম। টের পাচ্ছি আমার পায়ের তলায় মুকুলগঞ্জের সর্ষেখেত... চারদিকে লাল ফড়িং...আমার ফ্রক উড়ছে...উড়ছে শ্যামলদার পাঞ্জাবি।

0 comments:

প্রিয় কবিতারা...