Tuesday 24 June 2014

 উৎসর্গঃ মীরাবাঈ
(এই গল্পের নায়িকা)
গভীর রাত ।
বিদীর্ন আকাশের ক্ষীণ আলো নিয়ে নক্ষত্রেরা জ্বলে আছে । কিন্তু কোন অদ্ভুত কারণে আকাশময় শুভ্র আলো । সেই আলো এসে ঠিকরে পড়েছে নদীর জলে । নদীতে স্মিত ঢেউ ।
নৌকাটা পুরনো । আমি বসে আছি পাটাতনে । একা । মাথার উপর স্তব্ধ আকাশ । চারদিকে অবারিত জলস্রোত । অনেক দূরে আবছা অস্পষ্ট আধারে পাহাড়তলী হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকে ।
নক্ষত্রের ক্ষীণ আলোয় আমি চুপচাপ বসে আছি । নৌকা দুলছে । ঢেউ উঠছে । তীব্র ঢেউ । অথচ আমার এগুলো নিয়ে মোটেই ভাবনা হচ্ছে না । আমি ডুবে আছি তোমাতে । মীরাবাঈ ।
সেই কতকাল আগের কথা । ভাসা ভাসা স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে । ঐ যে আমি বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে পাহাড়তলী গেলাম । ভাবতেও পারিনি জানো । ভাবতেও পারিনি এমন ঘন অরন্যের ভেতর । এমন নিশ্ছিদ্র সবুজ পাহাড়ের ভেতর একা একটি মেয়ে বাস করতে পারে ।
তোমাকে যখন প্রথম দেখলাম । খুঁজে পেলাম । চোখের ভেতর কি গভীর মায়া । যেন পরম করুণাময় এক সমুদ্র মায়া তোমার চোখে এঁকে দিয়েছেন । পরম মমমাতায় । তুমি কিন্তু আমার সাথে কোন কথাই বলনি তখনও ।
তখন ভরা শ্রাবণ । রাতভর বর্ষণ । তুমি আমাদের গান শুনালে । কি সে সুর । কি জাদুময় কণ্ঠ । অথচ দেখ আমি তোমার গান শুনতেই পাচ্ছিলাম না । আমার বন্ধুটি এতো মাতলামি করছিল । ওর হৃদে কি আর জাদু ছুয়? ও শুধু বলছিল,
‘গাঁজা খাব আটি আটি
মদ খাব বাটি বাটি
ও মীরাবাঈ...
মীরাবাঈ, তুমি আমার সাথে কেন একটা বিন্দুও কথা বললে না সেদিন । আমরা ভোরে যখন পাহাড়তলি থেকে ফিরে আসলাম । তুমি কথা বলনি । আমি পিছনে ফিরে যখন হতাশ চোখে তাকালাম । তুমি তোমার অদ্ভুত মায়াময় চোখে তাকালে । কি জাদু ছিল সে চোখে! এখনো চোখে ভাসে!
আমি পারলাম না । দু দিন পর চুরের মত তোমার কাছে এসেছিলাম । তারপর লজ্জায় ফিরে গেলাম । ছিঃ! কি করছি আমি । একজন বাইজীর প্রেমে কিনা একজন কুলীন ব্রাহ্মণ! না এ হতে পারে না ।
আমি ফিরে গেলাম ঠিকই । কিন্তু রাতে ঠিকমত ঘুম হয় না । একটু চোখ বন্ধ করলেই । তোমার মায়াময় চোখ ভেসে উঠে । আশ্চর্য আমি তোমায় নিয়ে একটা স্বপ্নও দেখলাম ।
তুমি আর আমি নৌকায় করে কোথায় যেন যাচ্ছি । আমি বসে আছি পাটাতনে । তুমি আমার পাশেই । তোমার পরনে লাল রঙের একটা শাড়ি! মাথায় ঘোমটা টানা । চারদিকে ফিনিক দিয়ে জোছনা ঠিকরে পড়েছে!
মীরাবাঈ, আমি যখন পরের সপ্তাহে সত্যি সত্যি তোমার সাথে দেখা করলাম । তুমি কি ভেবেছিলে? কিছু তো ভেবেছিলে নিশ্চয়ই । কেমন করে যেন হাসলে । রাতের বেলা ফিস ফিস করে বললে,
- বাবু তোমার নাম কি গো?
আমি আশ্চর্য । তুমি আমার নাম জানো না?
- জানি গো বাবু । বন্ধুরা তো অভি বলে ডাকে । ভালো নাম টা কি?
- অভিজিৎ । অভিজিৎ দেবনাথ ।
- তোমায় একটা কথা বলতুম । রাগ করবে না তো?
- বল ।
- তুমি কি আমার প্রেমে পড়েচ?
আমি অবাক দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে রইলাম । কি সহজ ভাবেই কথাটা
না তুমি বললে । যে কথাটা আমার গলায় অনন্ত কাল ধরে গলায় কাঁটার মত আটকে ছিল ।
- শুধু প্রেম? নাকি আমায় বিয়ে করবে ভাবচ?
বলেই তুমি খিলখিল করে হাসলে । আমি আহত চোখে তোমার দিকে তাকালাম । তুমি আমায় তিরস্কার করছ? ভাবলাম । বাইজী আবার প্রেমের কি বুঝে রে? শুধু শুধু এসেছি । সকাল হোক । বাটি চলে যাব ।
তুমি আমায় বললে,
- অভি বাবু, রাগ করেচ? শোন গো বাবু । যে ফুল বনে ফুটেছে । সে ফুলকে গোলাপের মত কি ফুলদানী নিলে ফুলদানীরই যে অপমান হয় । রাগ করো না । ওসব তোমার ঘোর গো বাবু । বাড়ি গিয়ে বিয়ে কর । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
আমি তীব্র রাগ নিয়ে বারান্দায় এলাম । বৃষ্টি নেমেছে । বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটতে শুরু করলাম । রাতেই বাড়ি যাব । এখানে আর না ।
বাড়ি যাওয়া হল না । উঠোনে দাঁড়াতেই প্রচণ্ড শব্দে ঝড় শুরু হল । গাছের বিরাট একটা ডাল ভেঙ্গে আমার পায়ে পড়ল । আমার পা ছিলে রক্ত বের হতে লাগল ।
তুমি এলে । আমায় ঘরে নিয়ে শুয়ালে । সে রাতে কি যে জ্বর । মীরাবাঈ, তোমার মনে আছে ? সারারাত এক মিনিটের জন্য বৃষ্টি থামেনি । তুমি সারাক্ষণ আমার পাশে বসে ছিলে ।
মোমবাতির আলোয় সে মুখ এখনো যে ভাসে । মীরাবাঈ । এখনো যে সে রাতের তোমার প্রতিটা ঘুমহীন চোখের পলক মনে হয় । পনের দিনের জ্বরে পড়ে রইলাম তোমার কাছে । তারপর যখন সুস্থ হলাম । সাহসী গলায় বললাম,
- ‘মীরাবাঈ, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই’
তুমি হাসলে । আমি অস্থির হয়ে গেলাম । তোমার হাত ধরে বললাম । তুমি বললে,
- তা হয় না বাবু । আমি কোন এক বনের বিষাক্ত ফুল । আমায় দিয়ে এসব হবে না বাবু । তুমি ঘরে ফিরে যাও ।
আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল । তুমি আমার চোখ মুছতে গিয়েও মুছলে না । এতো নিষ্ঠুর কীভাবে হয়েছিলে মীরাবাঈ? বললে,
- তুমি ঘুমিয়ে পড় । রাতটা কাটুক । কাল তুমি বাড়ি ফিরে যাও অভি বাবু
সে রাতে আবার বৃষ্টি নামল । প্রচণ্ড বৃষ্টি । আমি গভীর বিষাদ আর তীব্র হতাশা নিয়ে নানান চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম । শেষ রাতে ঝড় শুরু হল । প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল । আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল ।
আমি ক্ষীণ গলায় ডাকলাম, মীরাবাঈ! কোন উত্তর পাওয়া গেল না । বারন্দায় এসে দেখি তুমি উঠোনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছ । আমাকে দেখে অপরাধীর মত হাসলে । আমি অবাক হয়ে গেলাম । তোমার চোখ এতো লাল কেন?
শেষ রাতে শরীর কাঁপিয়ে তোমার জ্বর এলো । তুমি জ্বরের ঘোরে প্রায় অচেতন পর্যায়ে চলে গেলে । আমি বললাম,
- তুমি কেন সারারাত বৃষ্টিতে ভিজলে?
তুমি হাসলে । আমি চোখ মুখ শক্ত করে বললাম,
- বল কেন ভিজলে
তুমি আবারো হাসলে । আমি তোমার কপালে হাত রাখলাম । কি জ্বর! কপালে হাত দিলে মনে হয় হাত পুড়ে যাবে । বিকেলে তোমার জ্বর থামল । তুমি বিছানায় উঠে বসলে । বললে,
- অভি বাবু
- বল
- তুমি কি আমার উপর রাগ করেচ?
- না
- করেচ বাবু । আমি জানতুম তুমি রাগ করবে । কিন্তু...
তুমি কথা বন্ধ করে আমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বললে তোমার মাথাটা কেমন যেন লাগছে । আবার শুয়ে পড়লে । আমি বারান্দায় এসে তোমার চিঠি পড়লাম । কিছুক্ষণ বারন্দায় বসে রইলাম । তারপর সন্ধ্যা নামার পর ঘরে গিয়ে দেখলাম তুমি ঘুমোচ্ছ ।
সন্ধ্যা বেলায় ঘুমানো ভালো না । আমি তোমায় ডাকলাম । মীরাবাঈ!
তুমি সাড়া দিলে না । আর সাড়া দিলে না তুমি । চলে গেলে অনেক দূরে । আমাকে ছেড়ে । ঘন অরন্য । নিশ্চিদ্র সবুজে ঘেরা পাহাড় । নদী । সমুদ্র পেরিয়ে । ওপারে!
মীরাবাঈ, আমি এখনো তোমায় ভালোবাসি । এই যে দেখ । গভীর রাতে নৌকায় একা বসে থাকি । ভাবি ঐ যে একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম । আমি নৌকার পাটাতনে বসে আছি । তুমি আমার পাশে । পরনে লাল রঙের শাড়ি ।
যদি কোন অলৌকিক উপায়ে হঠাৎ দেখি তুমি আমার পাশে সত্যি সত্যি বসে আছো । সত্যি যদি তুমি ফিরে আসো ।
আকাশে মেঘ জমেছে । নক্ষরেরা মেঘের আড়ালে নিভে গেছে । আমি হারিকেনে আলোটা বাড়িয়ে দিলাম । সেই পুরনো চিঠি তোমার । তুমি লিখেছ,
অভি,
তুমি জানো না । আমি তোমাকে কত ভালোবাসি । আমি নিজের কথা ভাবি না । ভাবি তোমার কথা । আমার কি দুর্ভাগ্য দেখ না । তুমি আমার এতো কাছে তবু তোমায় ছুতে পারি না । একটু সাহস করে বলতে পারি না । ভালোবাসি । অনেক ভালোবাসি তোমাকে । অনেক অনেক অনেক ।
মীরাবাঈ
বৃষ্টি পড়ছে । ভিজে যাচ্ছি আমি । ভিজুক । বৃষ্টির জল যদি এসে চোখের জল আড়াল করে দেয় । ঘন ঘন মেঘ ডাকছে । আমি নৌকায় বসে চিৎকার করে বললাম, মীরাবাঈ আমি তোমাকে এখনো ভালোবাসি ।
হঠাৎ নৌকাটা দুলে উঠল । ক্ষীণ চুরির আওয়াজ শোনা গেল । বৃষ্টি পড়ছে । কিন্তু মেঘ কেটে চাঁদ ভেসে উঠেছে । সেই আলোয় আমি কি দেখছি? একী! আমার সামনে মীরাবাঈ বসে আছে । তার পরনে লাল রঙের শাড়ি । এই তো সেই চোখ । কি মায়াময় দুটি চোখ!
আমি বিড়বিড় করে বললাম,
- আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?

0 comments:

প্রিয় কবিতারা...